সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩০ অপরাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ বরিশাল নগরীর বাসিন্দাদের পাঁচ বছর আগে দেওয়া কোনও প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি কাউন্সিলররা। এমনকি ওয়ার্ডভিত্তিক কোনও ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে পারেননি তারা। এ অবস্থায় শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়েও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন এসব জনপ্রতিনিধি।
তাদের দাবি, সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর কাছে ওয়ার্ডবাসীর দাবি ও সমস্যাগুলো তুলে ধরতে না পারা এর অন্যতম কারণ। গত পাঁচ বছরে মেয়র কোনও ধরনের বরাদ্দ দেননি। এমনকি সমস্যার কথাগুলো কখনও শোনেননি। নিজের মনমতো কাজ করেছেন। এ জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছেন কাউন্সিলররা।
তবে নগরবাসী এ জন্য কাউন্সিলরদের দায়ী করছেন। তারা বলছেন, গত পাঁচ বছরে কোনও ওয়ার্ডে কোনও ধরনের উন্নয়ন হয়নি। এমনকি সড়কগুলো সংস্কার হয়নি। তবে ঠিকই পৌরকরসহ যাবতীয় কর পরিশোধ করেছেন নগরবাসী।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত মেয়াদে ৩০টি সাধারণ ও ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত ৪০ জন কাউন্সিলর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার চার বছর আট মাস পার হলেও একটি প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন করেননি। এখন আবার চলছে নির্বাচনি প্রচারণা। আবারও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোটারদের কাছে এসেছেন তারা।
এ নিয়ে ভোটাররা বলছেন, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসা সেসব কাউন্সিলরকে আমরা বিগত বছরে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি। এ নিয়ে অনেকে বিব্রত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ নতুন কৌশলে ভোট চাচ্ছেন। কেউ মেয়রকে দোষারোপ করছেন। আসলে সব ব্যর্থতা জনপ্রতিনিধিদেরই।
১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান কাউন্সিলর গত পাঁচ বছরে এলাকায় কোনও উন্নয়ন করেননি। বিভিন্ন সময়ে তাকে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের কথা বললেও হবে-হচ্ছে বলে সময় কাটিয়েছেন। তার কার্যালয় থেকে শুধুমাত্র নাগরিকত্ব সনদপত্রটাই ঠিকমতো পাওয়া গেছে। আর কিছুই পাইনি। তার আগে জসীম উদ্দিন কাউন্সিলর ছিলেন। এই এলাকায় একটি ড্রেন করার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিলেন। ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ড্রেন নির্মাণ হয়নি।
একই এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, ‘সাধারণ কিংবা সংরক্ষিত কোনও কাউন্সিলরের কাছ থেকেই কোনও উন্নয়ন পাওয়া যায়নি। এখন আবার ভোট এসেছে। প্রার্থীরা আশ্বাস দিচ্ছেন। প্রতিবার তাদের আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস রেখে ভোট দিয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত করেছি। কিন্তু জয়ের পর তারা বদলে যান। এখন সময় এসেছে আমাদেরও বদলে যাওয়ার। তাদের বয়কট করার কথা ভাবছি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গত পাঁচ বছরে কোনও উন্নয়ন না হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মেহেদী পারভেজ আবির। তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর সিটি করপোরেশন থেকে কোনও ধরনের বরাদ্দ না দেওয়ায় ওয়ার্ডে কোনও উন্নয়ন করতে পারিনি। মেয়রকে সমস্যার কথা বলতে পারিনি। কারণ তার দেখাই পাননি আমার মতো অধিকাংশ কাউন্সিলর।
কোনও উন্নয়ন না হওয়ার অভিযোগ করেছেন ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মনোজ কুমার চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘আমার এলাকার কাউন্সিলর এনামুল হক বাহার। তিনি নির্বাচনের আগে উন্নয়নের অনেক আশ্বাস দিয়েছেন। এর মধ্যে একটিও বাস্তবায়ন করেননি। এই ব্যর্থতার দায়িত্ব কাউন্সিলরকেই নিতে হবে।
এমন অভিযোগের বিষয়ে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এনামুল হক বাহার বলেন, ‘মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর কাছে এলাকার উন্নয়ন নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। মেয়র আমাদের ১৩ কাউন্সিলরকে পছন্দ করতেন না। ফলে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তার কাছে এলাকার উন্নয়নে কোনও কথা বলতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় আমার।
২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সোয়াইব সাকির বলেন, ‘আমার এলাকার কাউন্সিলর জাতীয় পার্টির নেতা মর্তুজা আবেদীন। তিনি গত পাঁচ বছরে এই ওয়ার্ডে কোনও ধরনের উন্নয়ন করেননি। এমনকি কাউন্সিলর কোনও রাস্তাঘাট সংস্কারের কাজ করেননি। এবার ভোট চাইতে এলে তার কাছে এর জবাব চাইবো আমরা।
ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে কাউন্সিলর মর্তুজা আবেদীন বলেন, ‘এলাকার কাউন্সিলর আমি। অথচ মেয়র তার নিজস্ব লোক দিয়ে সব ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। বিশেষ করে করোনাকালীন ত্রাণ এবং টিসিবির মালামাল তার লোকজন তাদের পছন্দের লোকজনের মাঝে বিতরণ করেছেন। ফলে উন্নয়ন দূরে থাক, হতদরিদ্রদের ত্রাণ দিতেও ব্যর্থ হয়েছি আমি। এ অবস্থায় নিজস্ব তহবিল থেকে যা পেরেছি, সেভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছি।
৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শিশির কুমার বৈরাগী বলেন, ‘বর্তমান কাউন্সিলর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বলে আসছেন বরাদ্দ না পাওয়ায় উন্নয়ন করতে পারছেন না। ফলে ওয়ার্ডে কোনও উন্নয়ন হয়নি। তবে এজন্য শুধু কাউন্সিলরকে দোষ দিলে হবে না। কাউন্সিলর যার মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প আনবেন, সেই মেয়রই বরাদ্দ পাননি। ফলে শুধু ওয়ার্ডে নয়; নগরীতে তেমন কোনও উন্নয়ন হয়নি।
মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন সিটি করপোরেশনে যেন কোনও কাউন্সিলর না যান—এমন অভিযোগ করেছেন ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউর রহমান বিপ্লব। তিনি বলেন, ‘এমন নির্দেশের কারণে কোনও কাউন্সিলর সিটি করপোরেশনে যেতেন না। এলাকার সমস্যার কথা বলতে মেয়রের কাছে গেলেও সিটি করপোরেশনে তাকে পাওয়া যেতো না। কারণ মেয়রের কার্যক্রম শুরু হতো সন্ধ্যার পর। নগরীর ফকিরবাড়ি রোডের বাসভবনে বসে কাজ করতেন। বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাজ মেয়র নিজের লোক দিয়ে করাতেন। এসব কারণে করোনাকালীন অনেকে ত্রাণ পাননি। চার বছর আট মাসে নিজস্ব তহবিল থেকে হতদরিদ্রদের সহায়তা করেছি। বরাদ্দ না পাওয়ায় এলাকার কোনও উন্নয়ন করতে পারিনি।
তবে ভিন্ন কথা বলেছেন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সালমা আক্তার শিলা। তিনি বলেন, ‘সড়ক, ড্রেন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে এলাকাবাসীর সুখে-দুঃখে পাশে থাকা জরুরি ছিল। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তার যেসব ভাতার কার্ড পেয়েছি, সেগুলো বিতরণ করেছি। টিসিবির পণ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছি।
একাধিক ওয়ার্ডের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৪০ জন কাউন্সিলর কোনও একটি প্রতিশ্রুতি রাখেননি। ৪০টি ওয়ার্ডে কোনও ধরনের উন্নয়ন হয়নি। তাদের মেয়াদের আগে যেসব উন্নয়ন হয়েছে, সেগুলো দিয়েই পাঁচ বছর কাটিয়েছেন এসব জনপ্রতিনিধি।
এ ব্যাপারে ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল হোসেন লিটু বলেন, ‘সিটি করপোরেশন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। যদি সরকার থেকে সহযোগিতা করা না হয়, তাহলে এই প্রতিষ্ঠান নগরবাসীকে সুযোগ-সুবিধা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। উন্নয়নের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েও অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তারপরও মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ নিজস্ব তহবিল থেকে স্থায়ী উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়েছেন। যে সড়ক পাঁচ বছরে তিন-চার সংস্কার হতো সেই সড়ক পাঁচ বছরের গ্যারান্টি দিয়ে একবারেই সংস্কার করিয়েছেন। তবে এটি সত্য, কোনও ধরনের বরাদ্দ না পাওয়ায় আমরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে পারিনি।
এসব বিষয়ে জানতে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে একাধিকবার ফোন দিলেও ধরেননি। তবে বিভিন্ন সময় সাদিক আব্দুল্লাহ বলেছেন, বরাদ্দ না পাওয়ায় তিনি গত পাঁচ বছরে কোনও ধরনের উন্নয়ন করতে পারেননি।
এদিকে, এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে বরিশালে কোনও উন্নয়ন হয়নি। নগরবাসী আমাকে নির্বাচিত করলে তাদের প্রত্যাশা পূরণে শতভাগ স্বচ্ছ থেকে কাজ করার চেষ্টা করবো।
প্রসঙ্গত, আগামী ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাধারণ কাউন্সিলর ৩০টি পদের বিপরীতে লড়ছেন ১৩৩ জন। ১০টি সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ৪০ প্রার্থী। এর মধ্য থেকে পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেবেন নগরবাসী।
Leave a Reply